বিশেষ প্রতিনিধি: পুঁজিবাজারে চলছে নানান সংকট। সবচেয়ে বড় সংকট নতুন আইপিও না আসা। তবে প্রায় ২ মাস থেকে মন্দা পুঁজিবাজারে গতি ফিরতে শুরু করেছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরে পুঁজিবাজারের লেনদেন আগের এক বছরের তুলনায় কমেছে ১৯ শতাংশের বেশি। সূচকও কমেছে ৮ শতাংশের বেশি। এই সময়ে বাজার মূলধন বা সম্মিলিতভাবে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের দাম সম্মিলিতভাবে বেড়েছে দেড় শতাংশের বেশি।
সূচকের উত্থান-পতনে বিচলিত নন পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা। বাজারে লেনদেনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর লেনদেন কমে যাওয়াকে পুঁজিবাজারের জন্য ‘চরম’ নেতিবাচক বলে মনে করেন তাঁরা।
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদের হার বৃদ্ধি, কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমে যাওয়া, ভালো শেয়ারের অভাব, বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব এবং দেশে ক্ষমতার পালাবদল ও নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক চাপের বিষয়গুলো প্রভাব ফেলেছে পুঁজিবাজারে। এতে লেনদেনসহ পুঁজিবাজারের সব সূচকেই অবনতি দেখা গেছে।
ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের গবেষণা প্রধান সেলিম আফজাল শাওন বলেন, বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ঘটনার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ, ভারত-পাকিস্তান এবং ইরান-ইসরায়েল সংঘাত, দেশে জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘিরে রাজনৈতিক চাপের বিষয়গুলো রয়েছে। অন্যদিকে সুদের হার এখনো অনেক বেশি, আর ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ (এনপিএল) উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে লেনদেন হয়েছে ২৩৮ কার্যদিবস। এই সময়ে পুঁজিবাজারে টাকার অংকে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন লেনদেন হয়েছে ৪৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
তার আগের এক বছরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে ২৩৭ কার্যদিবস। এই সময়ে টাকার অংকে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এই সময়ে গড়ে প্রতিদিন লেনদেন হয়েছে ৬১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে আগের বছরের তুলনায় পুঁজিবাজারে ২৮ হাজার ৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা বা ১৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম লেনদেন হয়েছে। আর প্রতিদিন গড়ে লেনদেন কম হয়েছে ১২০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৯২৪ পয়েন্টে, যা চলতি বছরের একই দিনে এসে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪০৮ পয়েন্টে। অর্থাৎ, এক বছরে সূচক কমেছে ৫১৬ পয়েন্ট বা ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সূচক কমলে লেনদেন কমে যায়। ব্যাংক, বিমা, ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব খাতের কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। আগের বছরগুলোতে এর পারফরম্যান্স কিছুটা ভালো ছিল। অন্যদিকে ভালো শেয়ারের সংখ্যাও অপ্রতুল। পুঁজিবাজারে ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়নি। মানুষ কেন রিস্ক নেবে? বিপরীতে সুদহার বেড়েছে। ফলে পুঁজিবাজার থেকে টাকা চলে গেছে বন্ড মার্কেটে।
সূচক পতন নিয়ে বিচলিত নন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শরীফ আতাউর রহমান। তিনি বলেন, সূচক আমাদের কাছে তেমন কোনো প্যারামিটার নয়। আমাদের কাছে ভলিউম বা লেনদেনটা বড় বিষয়। গত ১৫ দিন থেকে লেনদেন বাড়ছে। তবে তার আগে বেহাল দশা ছিল।
লেনদেন কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে শরীফ আতাউর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে মানুষ বা বিনিয়োগকারী নেই। বিনিয়োগকারীরা হাউজে আসেন না। আমার হাউজের গ্রাহক ছিল ১৬ হাজার। এখন তিন হাজারের কিছু কম রয়েছে। প্রতিদিন ১০০ জন বিনিয়োগকারীও লেনদেনে অংশ নেন না। যারা পুরোনো আছেন, তাঁদেরও সক্ষমতা নেই। মানুষ বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। টাকা নেই। যতটুকু লেনদেন হয়, সেটাও একটা বেচে আরেকটা কেনার কারণে হয়।
শরীফ আতাউর রহমান বলেন, বিনিয়োগকারীদের ৫০-৬০ শতাংশ টাকা নেই। যাঁরা ঋণ করে বিনিয়োগক করেছিলেন, তাঁদের কিছুই নেই। তারা বাজারে আর আসতেই পারবেন না।
গত বছরের ৮ আগস্ট ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৩ হাজার ৯১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা, যা এই বছরের এক তারিখে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ১৫ হাজার ৭৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বাজার মূলধন বেড়েছে ১১ হাজার ১৬৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা বা ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
পুঁজিবাজার সম্পর্কে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সংস্কার এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করছে কমিশন। ইতোমধ্যে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে বাজার আরও ভালো হবে বলে আশা করছে বিএসইসি।
Leave a Reply