নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারে বড় আশা নিয়ে গঠন হয়েছিল টাস্কফোর্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডজনখানেক ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিয়ে বাকি কাজ তুলে দেয় টাস্কফোর্সের হাতে। তবে কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই ঝিমিয়ে পড়েছে টাস্কফোর্স। আড়াই মাসের বেশি সময়ে তারা কেবল একটি সার্কুলার জারি করতে পেরেছেন। যেখানে আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগের নীতিমালা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা নির্ণয়ে অডিট কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। জানা গেছে, অর্থ সংকটে এসব ব্যাংক এখনই অডিট শুরু করতে আগ্রহী নয়।
জানা গেছে, প্রথম দফায় জানুয়ারিতে কয়েকটি ব্যাংকের অডিট শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে অর্থ সংকটে ইসলামি ধারার বড় ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষা কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে। টাস্কফোর্সের একাধিক সদস্য এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কবে থেকে এসব ব্যাংকের অডিট শুরু হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি টাস্কফোর্স সংশ্লিষ্টরা।
টাস্কফোর্সের একাধিক সদস্য বলেন, টাস্কফোর্স গঠনের শুরুতে ইসলামি ধারার বড় ব্যাংকগুলোকে অডিট কার্যক্রম শুরুর তালিকার শীর্ষে রাখা হয়েছিল। তবে তারল্য সংকটে থাকার কারণে কয়েকটি ব্যাংক এই মুহূর্তে অডিটের জন্য টাকা খরচ করতে পারবে না। এজন্য তাদের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরে শুরু হবে। তবে জানুয়ারিতে কয়েকটি ছোট ব্যাংকে অডিট শুরু হবে।
ঋণ কেলেঙ্কারি ও ব্যাপক খেলাপি ঋণে অস্থির হয়ে ওঠা ব্যাংক খাত সংস্কারে গত ১১ সেপ্টেম্বর ছয় সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আড়াই মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে পারেনি টাস্কফোর্স। এর ফলে টাস্কফোর্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান বিশ্লেষকরা।
ব্যাংক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক হিসেবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এতে আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ ছয়জনকে সদস্য করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের ছয় সদস্য হলেন- প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী, ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মেহরিয়ার এম হাসান, বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের উপাচার্য এম জুবায়দুর রহমান ও হিসাববিদ কোম্পানি হুদা ভাসি চৌধুরীর অংশীদার সাব্বির আহমেদ।
এই টাস্কফোর্স কী কী করবে সে বিষয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। তবে কত দিনে কাজগুলো করা হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, এ টাস্কফোর্স আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ব্যাংক খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান প্রধান ঝুঁকিসমূহ নিরূপণ, দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ এবং প্রভিশন ঘাটতি নিরূপণ করবে।
এ ছাড়া তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সংকটকালীন প্রতিঘাত সক্ষমতা অর্জনে ব্যাংকের সুশাসন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়ার আওতায় রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক উন্নয়ন, ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক এবং করপোরেট প্রভাব সীমিত করা হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের মালিকানা সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রদান, সংকটে থাকা ব্যাংকের জন্য রিকভারি এবং রেজুলেশন ফ্রেমওয়ার্ক ও সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন প্রস্তুত করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিগত ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে জোর দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আহসান এইচ মনসুরকে। এরপর ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। এসব ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে মোটা অঙ্কের ঋণ বের করে নেয় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী। এর ফলে তারল্য সংকটে পড়ে এসব ব্যাংকের স্বাভাবিক লেনদেন কার্যক্রম অস্থির হয়ে উঠেছিল। তবে সে ক্ষেত্রে তারল্য সহায়তা দিয়ে সংকট সমাধানে কিছুটা এগিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংকটে থাকা এসব ব্যাংকেই মূলত টাকার অভাবে অডিট কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্সগুলো যাতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্য দেশি-বিদেশি সর্বোচ্চ কারিগরি জ্ঞান ও সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার মধ্যে বিদেশি দুই ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এডিবি মিলে ১৭০ কোটি ডলার দিতে পারে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণ পাওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এসব ঋণদাতা সংস্থা থেকে ঋণ পেতে অনেক সময় লাগে। ঋণ অনুমোদনের আগে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ঋণ অনুমোদন পেলেও তা ছাড় পেতে কয়েক মাস সময় লাগে।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের ঋণে নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে। আর এডিবির ঋণের অর্থও এই প্রকল্পে ব্যবহার করা হতে পারে। তবে এডিবির জন্য পৃথক প্রকল্প গঠন করা হতে পারে। এডিবি ঋণ দেবে বাজেট সহায়তা হিসেবে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও কারিগরি জ্ঞান নেওয়া হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেছেন, অডিট করা বা আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা একটি প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট সুশাসনের অংশ। তবে এসব ব্যাংক যদি কোনো কারণে অডিট করাতে না পারে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তা দেখা উচিত
Leave a Reply