নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। টানা ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটে পুরো আর্থিক খাত তছনছ হয়ে গিয়েছে।
১৬ বছরে বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি, রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক দখল ও বিদেশে অর্থ পাচারে সরকারের মূল সহযোগী ছিলেন ব্যাংক খাতের তিন গভর্নর।
তারা হলেন- ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুল রউফ তালুকদার। হাসিনার পতনের পর নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর অনেক রাঘব বোয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন গভর্নর।
এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে নানা প্রশ্ন। এখনও কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই তিন গভর্নরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ বা তলবও করা হয়নি। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। যদিও বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার প্রধানদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।
অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন লুটপাটের অন্যতম সহযোগী আব্দুল রউফ তালুকদার বিশেষ সংস্থার ছত্রছায়ায় আছেন। আরেক গভর্নর ফজলে কবির ৫ আগস্টের পর থেকে উধাও। অন্যদিকে রিজার্ভ চুরির মূলহোতা আতিউর রহমান দেশের বাইরে চলে গেছেন।
গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকার শুধু উন্নয়নের গান গেয়ে গেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বেরিয়ে আসছে নজিরবিহীন নানা লুটপাটের তথ্য।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি জানিয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল হয়েছে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়। এই সুযোগে বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। সবশেষ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ। এ ছাড়া চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়। সম্প্রতি আহসান এইচ মনসুর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে আগামী দিনে মোট ঋণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এসব ঋণের বড় অংশই ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে, যার বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা নেওয়ার দিনে গভর্নর ছিলেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল তার মেয়াদ শেষ হলে নতুন গভর্নর হন আতিউর রহমান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরে তিনি পদত্যাগ করেন। তার সময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দিয়ে বিতর্কিত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর হলে একের পর এক ব্যাংক দখল হতে থাকে। এসব ব্যাংকে নির্বিচারে লুটপাট শুরু করে দখলকারীরা। নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশলও দেখা যায়। ২০২২ সালে গভর্নর পদে বসানো হয় আরেক সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে। তার আমলেও আগের ধারা অব্যাহত থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, আমলাদের শক্তিবলে এখনও ধরা পড়েননি ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। কারণ তারা সাবেক অর্থসচিব, অর্থাৎ আমলাই ছিলেন। তাদের দুজনের সহযোগী অনেকে এখনও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছে। আর তাদের শক্তি কাজে লাগিয়ে সাবেক এই দুই গভর্নর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালের বাইরে রয়েছেন।
আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের আগের ধারা অব্যাহত থাকে। একদিকে লুটেরারা ব্যাংক খালি করে বিদেশে পাচার করছিলেন। অন্যদিকে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলো ভরে দিচ্ছিলেন রউফ তালুকদার। অর্থাৎ ব্যাংক লুটের আরও সুযোগ করে দিয়েছিলেন সাবেক এই গভর্নর। তবে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর তারও রক্ষা হয়নি। কারণ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদারও লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের শেষ দিকে অর্থাৎ আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থায় ব্যাংক খাতে তদারকি কমিয়ে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে হলমার্কের জালিয়াতি ফাঁস হয়। এরপরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। একই গভর্নরের আমলে বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি হয়। এ ছাড়া ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বেশ কয়েকটি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়। এভাবেই ব্যাংক লুটপাটের সূচনা করে গেছে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। এরপর ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হলে আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ফজলে কবির। এরপর ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) দখল করতে সহায়তা করেন তিনি। তারপর এসব ব্যাংকে লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দিতে তদারকি কমিয়ে আনেন ফজলে কবির। তার সময়ে ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রেখে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক সুবিধা দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলা হয় দেশের ব্যাংক খাত।
২০২২ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার যোগদান করেন। তিনি ফজলে কবিরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে দেশের ১২তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর আগে ছিলেন অর্থসচিব।
শেখ হাসিনার সরকারে নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন ছিলেন তালুকদার। গভর্নর হওয়ার আগে অর্থসচিব থাকাকালেই তিনি নানা নীতি প্রণয়ন, এস আলম, বেক্সিমকো, আবুল খায়ের, নাসাসহ অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দিয়েছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই গভর্নরের মতোই তার সময়েও ব্যাংক ঋণে জালিয়াতি ও অনিয়ম অব্যাহত থাকে। লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোতে তিনি টাকা ছাপিয়ে তারল্য সুবিধা দিয়েছেন। বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদেরও রিজার্ভ থেকে ব্যাপক হারে ডলার দেওয়া হয়। ফলে দুই বছরের মধ্যে রিজার্ভ তলানিতে নামে। তার সময়েই আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের পতন ঘটলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের নিয়ে একটি গ্রেডিং সূচক প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ওই সূচকে পেয়েছেন ‘ডি গ্রেড’।
বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন। একই সঙ্গে বিভিন্ন অনিশ্চয়তা ও বাইরের চাপের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
Leave a Reply