নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ৬ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। তারা ব্যাংক কোম্পানি আইন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ইত্যাদির সংস্কার এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, ব্যাংক অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণ–সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, সংস্কার ও যুগোপযোগীকরণের প্রস্তাব দেবে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশের পদক্ষেপও নেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তবে শুধু ব্যাংকিং খাতই নয়, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও (এনবিএফআই) সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদায়ী সরকারের সময়ে অনিয়ম ও লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে যে অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। ব্যাংকিং খাতের চেয়েও এনবিএফআইয়ে সংকট বহুগুণ। বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে তারল্য সংকটও। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে নতুন করে আমানতও রাখতে চাচ্ছেন না গ্রাহকরা। এ অবস্থায় এনবিএফআইয়ে সংস্কার করা জরুরি।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং খাত সংস্কারে যেহেতু টাস্কফোর্স হয়েছে, এখন সয়ংক্রিয়ভাবে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার হওয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিশ্চয় এ ব্যাপারে ভাববেন।
ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও চাচ্ছেন এই খাতে সংস্কার হোক। এ জন্য সম্প্রতি তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা গেছে। তারা বলছেন, খেলাপি ঋণবৃদ্ধিসহ নানা কারণে এনবিএফআইয়ের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমেছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সংস্কার ছাড়া কোনো বিকল্প নাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৩৮ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ ২৩ হাজার ২০৮ কোটি ৭০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর তিন মাস পর (এপ্রিল-জুন) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩৮৮ কোটি টাকা। তবে তিন মাসের ব্যবধানে ৪৭ হাজার আমানতকারী এনবিএফআই ছেড়ে চলে গেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা ছিল চার লাখ ২৭ হাজার ৩৪১ জন। আর জুন শেষে অর্থাৎ তিন মাস পর আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৭ জন। সেই হিসাবে তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে ৪৭ হাজার ৬০৪ জন। একক প্রান্তিকে আমানতকারী কমার সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল তিন হাজার ৮৮০ জন। এর আগে ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল ২৫ হাজার ৭৮২ জন। এর আগের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) এ সংখ্যা কমেছিল ১৮ হাজার ৪৯৩। এছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) এ সংখ্যা কমেছিল ৩৫ হাজার ৫ জন।
চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ছিল ৪৪ হাজার ৩০৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে আমানত বেড়েছে ৮ হাজার ১১৩ কোটি ৯ লাখ টাকা।
নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এই দুরবস্থার জন্য অনেকেই দায়ী করছেন বাংলাদেশ ব্যাংককে। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদাররা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন। তিনি চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপিসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করে ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়াই ঠিক হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মতোই কাজ করে। দেশে এতেোগুলো ব্যাংক থাকার পরও এনবিএফআই দরকার নেই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রেড জোনে ছিল ১৪টি। দুই বছর আগে ২০২১ সালে রেড জোনে ছিল ১২টি। অর্থাৎ এই খাতের প্রতি মানুষের আস্থা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
এদিকে গত বুধবার নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেছেন। জানা গেছে, তারা ব্যাংক খাত সংস্কারের পাশাপাশি একইসঙ্গে নন-ব্যাংকিং খাতেও সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টিতে সায় দেয়নি। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর তাদেরকে বলেছেন— ‘এনবিএফআই সংস্কারের কাজ শুরু করবেন এখন থেকে আরও তিন চার মাস পরে’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে টাস্কফোর্স গঠন করেছে তা শুধু ব্যাংকিং খাতের জন্য। অর্থনীতি ঠিক করতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে ব্যাংক খাত ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর চেষ্টা করছে।’
Leave a Reply