নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি ইতিবাচক ধারায় ছিল। তবে গত নভেম্বরে এসে হঠাৎ এ খাতে বিনিয়োগ কমিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ক্রয় বা নবায়নের চেয়ে বেশি অঙ্কে ভাঙা হয়েছে সঞ্চয়পত্র।
ফলে এ খাত থেকে সরকারকে ঋণ না পেয়ে উল্টো আগের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তথ্য বলছে, গত নভেম্বরে নিট বিক্রি ৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা ঋণাত্মক হয়েছে। অর্থাৎ ঐ মাসে কেনার চেয়ে ভাঙানোর চাপ বেশি ছিল। ফলে নিট বিক্রি বড় অঙ্কে ঋণাত্মক হয়ে যায়। সাধারণত ভাঙানোর চেয়ে কেনার পরিমাণ বেশি হলে তাকে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বিবেচনা করা হয়। এটাকে ঋণ বিক্রি ধরা হয়। আর কেনার চেয়ে ভাঙানো বেড়ে গেলে সরকারের ঋণ পরিশোধ হয়। এটাকে নিট বিক্রি ঋণাত্মক বলা হয়।
গত নভেম্বরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে চাহিদা অনুযায়ী সঞ্চয় করতে পারেনি। আবার গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ধনী গোষ্ঠীর অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
এছাড়া ব্যাংক আমানত ও সরকারের বিল-বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ ব্যাংক ও বিল-বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে সুদহার বাড়ানোর কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আগামীতে আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল এক হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের নিট বিক্রির ঋণাত্মক অঙ্ক বেড়েছে এক হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দুই হাজার ১৮৭ কোটি টাকা, দ্বিতীয় মাস আগস্টে দুই হাজার ৩৬ কোটি এবং তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে চার হাজার ১০৯ কোটি টাকা নিট বিক্রি ইতিবাচক ছিল।
নভেম্বরে নিট বিক্রি নেতিবাচক হলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) নিট বিক্রি ইতিবাচক রয়েছে। এ সময় নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় নিট বিক্রি ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা ঋণাত্মক ছিল।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘মানুষের গড় আয় কমে গেছে। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা যে পরিমাণ আয় রাখার কথা তা রাখতে পারছে না। আরও অনেকে জমানো টাকা ভেঙে ফেলছেন তাদের দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য। অন্যদিকে সম্পদশালীদের মধ্যে যারা নামে-বেনামে একসময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতেন, তাদেরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর শেষে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মোট স্থিতি ছিল তিন লাখ ৪৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা। যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা।
সুদহার বেড়েছে : প্রথমবারের মতো মার্কেট রেট বা বাজারে প্রচলিত সুদহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঁচটি জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণ করেছে সরকার। এতে প্রত্যেকটি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কিছুটা বেড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ গত ১৫ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে সঞ্চয়পত্রের সুদহার পুনঃনির্ধারণের বিষয়টি জানিয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নতুন সুদহার ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ, ১ জানুয়ারি বা তারপর থেকে যেসব গ্রাহকের সঞ্চয়পত্র কার্যকর হয়েছে, তারা নতুন বা বাড়তি সুদহার পাবেন। জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাস মেয়াদে নতুন সুদহার কার্যকর হবে। এ ছাড়া, এখন থেকে ৬ মাস পর পর বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
এতদিন যাবত তিন ধাপে বিনিয়োগে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ ছিল। ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা পেতেন সবচেয়ে বেশি সুদ। এরপর ১৫ লাখ এক টাকা থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে এক ধরনের সুদহার এবং ৩০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে বিনিয়োগে আরেক ধরনের সুদহার ছিল। বিষয়টি এমন ছিল যে, যার যত বেশি বিনিয়োগ, তার জন্য সুদহার তত কম।
নতুন প্রজ্ঞাপনে তিন ধাপের পরিবর্তে নতুন দুই ধাপ তৈরি করা হয়েছে। একটি ধাপ ৭.৫০ লাখ টাকা; আরেকটি ধাপ ৭.৫০ লাখ টাকার বেশি থেকে শুরু। এ ছাড়া, আগের মতো বিনিয়োগের মেয়াদপূর্তির আগে নগদায়নের ক্ষেত্রে বছরভিত্তিক হারে মুনাফা পাবেন গ্রাহক।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণিকে সমতা প্রদানের লক্ষ্যে এই ধাপ ও বিনিয়োগের পরিমাণে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এতে সরকার বা রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে। জানুয়ারি মাসে বাড়তি সুদে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। এতে নিট বিক্রি বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
Leave a Reply