নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের শেয়ারবাজারে অনিয়ম ও কারসাজি রোধ করতে এবার নিজস্ব অর্থায়নে নজরদারি বা সার্ভিল্যান্স সক্ষমতা বাড়াচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার বা সিস্টেমের হার্ডওয়ার ও সফটওয়্যার হালনাগাদকরণের (আপগ্রেড) মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে আগামীতে নজরদারিতে দুই-তিন গুণ সক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করে কমিশন।
বিএসইসি ২০১২ সালেরে শেষে দিকে সুইডেনের কোম্পানিস ট্র্যাপেটসের কাছ থেকে “ইনস্ট্যান্ট ওয়াচ মার্কেট” সার্ভিলেন্স সফটওয়্যার গ্রহণ করে। এটি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায়, সরকারের পুঁজিবাজার গভর্ন্যান্স উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা হয়। তবে সার্ভিলেন্স সফটওয়্যারটি স্থাপন করার পর থেকেই এখন পর্যন্ত এর কোনো হালনাগাদকরণ করা হয়নি। ফলে প্রযুক্তিগতভাবে এটি পুরোনো ও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তাই ডাটা সেন্টার তৈরির মাধ্যমে এরইমধ্যে হার্ডওয়ারের সক্ষমতা বাড়িয়েছে বিএসইসি। এতে বড় ধরনের লেনদেন বা তথ্য দীর্ঘদিন সংগ্রহের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সফটওয়ার উন্নত করার মাধ্যমে নজরদারির গতি বাড়বে। এর ফলে কারসাজি শনাক্তকরার পরিমাণও বাড়বে বলে মনে করে কমিশন।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন পুঁজিবাজারের সার্ভিল্যান্স সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে কারসাজিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নামে-বেনামে বিও হিসাব খুলে, কয়েকজন মিলে লেনদেন করে শেয়ারের দাম কমানো ও বাড়ানো। বিগত সময় এসব কারসজি বেশিরভাগ নজরে আসলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার বেনামে হওয়ায় অনেক কারসাজির সঠিক তথ্য বের করা যায়নি। তবে এবার সেই নজরদারি বাড়াতে সার্ভিল্যান্স সক্ষমতা বাড়াচ্ছে বিএসইসি।
গত ১৫ বছরে শেয়ারের সিরিয়াল ট্রেডিংসহ নানান ধরনের কারসাজি ছিল সহজ ও সাধারণ বিষয়। সে সময় ব্রোকারেজ, মার্চেন্ট ব্যাংক, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ব্যাংকসহ খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকজনের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ ওঠে। তৎকালীন নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঢিলেঢালা নজরদারি ও দায়সারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে অনেক বিনিয়োগকারীকে তাদের কষ্টের টাকা পুঁজিবাজারে হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকে।
গত বছরের ২৯ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, “ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতারণা, কারসাজিসহ প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং আইপিও বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে জালিয়াতির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারসাজির একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। বাজারের মধ্যস্থতাকারী দেউলিয়া হয়েছে, তাদের ইক্যুইটি ৩০ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক হয়েছে। যারা ব্যাংক খাতের অপরাধী, তারাও পুঁজিবাজারে আস্থা নষ্ট করার পেছনেও ছিল। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একটি স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তদন্তে কয়েকশ কোটি টাকা মুনাফার তথ্য থাকলেও জরিমান করা হয়েছে মাত্র কয়েক কোটি টাকা।”
শেয়ার কারসাজির বিষয়ে শ্বেতপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, “বেশ কিছু প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে নিজেদের মধ্যে একের পর এক লেনদেন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ায়। তারা ‘টার্গেটেড’ কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন করে, যেখানে কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনেন। এভাবেই ওই কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের সক্রিয় চেহারা দেখানো হয়। বুক বিল্ডিং প্রক্রিয়ায় এমনভাবে কারসাজি করা হয়, যাতে কোম্পানির মূল্যায়ন বোঝা না যায়।”
বিএসইসির মার্কেট সার্ভিল্যান্স অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স বিভাগ পুঁজিবাজারে লেনদেন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে, যাতে বেআইনি শর্ট সেলিং, ইনসাইডার ট্রেডিং, বাজার কারসাজি এবং অন্যান্য বাজার অপব্যবহারসহ যেকোনো ধরনের বাজার অসদাচরণ প্রতিরোধ ও সীমিত করা যায়। এই কাজের জন্য তারা ইনস্ট্যান্ট ওয়াচ মার্কেট সার্ভিলেন্স সিস্টেম থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন সতর্কবার্তা (অ্যালার্ট) পরিচালনা করে।
বিএসইসির সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার একটি স্বয়ংক্রিয় বাজার পর্যবেক্ষণ প্ল্যাটফর্ম, যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) লেনদেন, অর্ডার, এবং সংবাদগত তথ্য পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহভাজন কার্যক্রম শনাক্ত করতে পারে। অ্যালার্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি ইনসাইডার ট্রেডিং, বাজারে প্রভাব বিস্তার, অস্বাভাবিক কার্যক্রম শনাক্ত করে এবং তথ্য লিপিবদ্ধ করে।
Leave a Reply