নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) চলতি অর্থবছরের মুনাফা থেকে প্রভিশন না রেখেই মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ইউনিটহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে চায়।
গত শনিবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বাজারসংশ্লিষ্টদের এক বৈঠকে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ এই প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেন, আমরা চলতি অর্থবছরের অর্জিত মুনাফার ২০ শতাংশ প্রভিশনের জন্য রেখে বাকি ৮০ শতাংশ ইউনিটহোল্ডারদের মাঝে লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করতে চাই।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ফান্ডের মূলধন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়বেন ইউনিটহোল্ডাররাই।
বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে বিনিয়োগের আনরিয়েলাইজড লোকসানের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আইসিবি সেই নিয়ম শিথিল করে আংশিক প্রভিশনের পরই লভ্যাংশ দেওয়ার অনুমোদন চাচ্ছে।
আইসিবি বলছে, দীর্ঘদিন লভ্যাংশ না পেয়ে অনেক ইউনিটহোল্ডার হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতেই এই প্রস্তাব। তবে আইসিবি কর্তৃপক্ষ নিজেরাও স্বীকার করছেন, আংশিক প্রভিশন রেখে লভ্যাংশ দেওয়া উচিত নয়।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ না করেই লভ্যাংশ দিলে মূলধনই ঝুঁকিতে পড়বে।
বিষয়টি বোঝাতে একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে— ধরা যাক, একটি ফান্ড ১০০ টাকা বিনিয়োগ পেয়েছে। এর মধ্যে ১০ টাকা অবিতরিত ক্ষতি হয়েছে। এরপর চলতি অর্থবছরে ফান্ডটি ১০ টাকা মুনাফা করে।
আইসিবির প্রস্তাব অনুযায়ী, ১০ টাকার মুনাফা থেকে ২০ শতাংশ বা ২ টাকা প্রভিশনে রাখা হবে। বাকি ৮ টাকা লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়া হবে ইউনিটহোল্ডারদের। এর ফলে ফান্ডের মোট সম্পদ নেমে আসবে ৯০ টাকায়।
অর্থাৎ ইউনিটহোল্ডাররা তাদের আসল টাকার অংশ ফেরত পাচ্ছেন, প্রকৃত মুনাফা নয়। এক অর্থে, এটি মূলধনের ভাঙানো ছাড়া কিছুই নয়।
‘প্রভিশন ছাড়া লভ্যাংশ দেওয়া মানেই মূলধন ভেঙে ফেলা। এতে ফান্ডের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে পড়ে।’
২০২৪ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে ধসের কারণে বেশিরভাগ মিউচুয়াল ফান্ডই ক্ষতির মুখে পড়ে। ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকেও একই চিত্র ছিল। অথচ তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ ২০২৫) বাজার বেশি অস্থির থাকলেও অনেক ফান্ড মুনাফা করেছে।
যেসব ফান্ড আগেই আনরিয়েলাইজড লোকসানের শতভাগ প্রভিশন রেখেছিল, তাদের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা স্পষ্ট। যেমন—আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত ‘আইসিবি এএমসিএল সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ১ম মিউচুয়াল ফান্ড’ ২০২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতি ইউনিটে ০.১০ টাকা লাভ করেছে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে লোকসান করেছিল ১.২১ টাকা।
ফান্ড ম্যানেজাররা বলছেন, যথাযথ প্রভিশন এবং সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের কারণে এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘কোনো আর্থিক সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ হয় মুনাফা থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে। প্রভিশন যদি অসম্পূর্ণ থাকে, তাহলে সেই সম্পদের ন্যায্য মূল্য নিট অ্যাসেট ভ্যালুতে প্রতিফলিত হয় না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিবির প্রস্তাবটি হয়তো স্বল্পমেয়াদে ইউনিটহোল্ডারদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি ফান্ডগুলোর টিকে থাকার সক্ষমতা দুর্বল করে দেবে।
পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে নিয়মের বাইরে ছাড় না দিয়ে বরং প্রভিশনের মতো ভিত্তিগুলো আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
Leave a Reply